শহীদ শাহারিয়ার খান আনাস ছিলেন গেন্ডারিয়া আদর্শ একাডেমির বিজ্ঞান বিভাগের দশম শ্রেণির মেধাবী ছাত্র। ছোটবেলা থেকেই তিনি ন্যায়বোধে দৃঢ়, ভদ্র এবং স্বপ্নবান এক কিশোর ছিলেন। স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে একজন ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার। কিন্তু ২০২৪ সালের ভয়াবহ কোটা সংস্কার আন্দোলনে তিনি হয়ে ওঠেন বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের সাহস ও আত্মত্যাগের প্রতীক। কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু থেকেই আনাসকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল। বাবা-মায়ের সঙ্গে তিনি বিষয়টি শেয়ার করতেন না, কিন্তু মৃত্যুর পর তার পড়ার টেবিলে পাওয়া খাতায় দেখা যায়, আনাস ৭–৮ পৃষ্ঠা জুড়ে কোটা সংস্কার নিয়ে নিজের চিন্তাভাবনা লিখে রেখেছিলেন। তিনি দেশের অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন— নিপীড়নের মুখে শিক্ষার্থীদের পাশে থাকতে চেয়েছিলেন। ৪ আগস্টের লংমার্চের আগের রাতে, আনাস সিদ্ধান্ত নেন তিনি আন্দোলনে যোগ দেবেন। সেদিন রাতে স্কুল ব্যাগে কিছু জামাকাপড় ও ওষুধ গোপনে গুছিয়ে রাখেন। পরদিন সকাল ৯টার দিকে বাবা-মাকে না জানিয়ে তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে যান। যাওয়ার আগে নিজের স্কুল খাতায় লিখে যান এক হৃদয়বিদারক চিঠি—
‘’মা, আমি মিছিলে যাচ্ছি। আমি নিজেকে আর আটকিয়ে রাখতে পারলাম না। সরি আব্বুজান। তোমার কথা অমান্য কোরে বের হোলাম। স্বার্থপরের মতো ঘরে বোসে থাকতে পারলাম না। আমাদের ভাই রা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কাফনের কাপড় মাথায় বেঁধে রাজপথে নেমে সংগ্রাম কোরে যাচ্ছে। অকাতরে নিজেদের জীবন বিষর্জন দিচ্ছে। একটি প্রতিবন্ধি কিশোর, ৭ বছরের বাচ্চা, ল্যাংরা মানুষ যদি সংগ্রামে নামতে পারে, তাহলে আমি কেন বোসে থাকবো ঘরে। একদিন তো মরতেই হবে। তাই মৃত্যুর ভয় কোরে স্বার্থপরের মতো ঘরে বোসে না থেকে সংগ্রামে নেমে গুলি খেয়ে বীরের মৃত্যুও অধিক শ্রেষ্ঠ। যে অন্যের জন্য নিজের জীবনকে বিলিয়ে দেয় সেই প্রকৃত মানুষ। আমি যদি বেঁচে না ফিরি তবে কষ্ট না পেয়ে গর্বিত হয়ো। জীবনে প্রতিটি ভুলের জন্য ক্ষমা চাই’’। -আনাস
শহীদের শেষ পথযাত্রা
৫ আগস্ট সকালে আনাস প্রথমে যান তাঁতিবাজার এলাকায়। সেখানকার কয়েকজন আন্দোলনকারী ছাত্রের সঙ্গে যোগাযোগ হয় তার। তিনি বলেন, “আপনারা আন্দোলনে যাচ্ছেন?” পরিচয় জানার পর তারা আনাসকে সঙ্গে নেয়। তাদের পরিকল্পনা ছিল বকশিবাজার হয়ে ঢাকা মেডিকেল হয়ে শহীদ মিনার ও শাহবাগের দিকে অগ্রসর হওয়া। চাঁনখারপুলে পৌঁছে ছাত্ররা জড়ো হতে থাকে। সেখানে আনাসের সঙ্গে এক ভাইয়ের পরিচয় হয়, যিনি পরে আনাসের শেষ মুহূর্তের সাক্ষী হয়ে ওঠেন। ঐ ভাই যখন আনাসের বড় ব্যাগ দেখে প্রশ্ন করেন— “তুমি ব্যাগ নিয়ে বের হয়েছ কেন?” আনাস শান্তভাবে উত্তর দেয়,
“বাসায় ফিরলে আর বের হতে দেবে না। তাই জামাকাপড় নিয়ে এসেছি, আন্দোলন শেষ না হওয়া পর্যন্ত বাইরে থাকব।”
এরপর আনাস আরও বলেছিল,
“যদি আমার গায়ে গুলি লাগে, গুলি যেন হাতে-পায়ে না লাগে — গুলি লাগলে যেন আমি শহীদ হই।” এর কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশ টিয়ারগ্যাস ও রাবার বুলেট ছুঁড়তে শুরু করে। একটি রাবার বুলেট আনাসের গায়ে লাগে, কিন্তু সে পিছু হটে না। পরে কয়েকজন সহযোদ্ধার সঙ্গে দৌড়ে আশ্রয় নেয় নিমতলির ৯ নং নবাব কাটার গলিতে। এটি ছিল একদম সরু ও বন্ধ গলি। পুলিশ ড্রোন দিয়ে অবস্থান শনাক্ত করে। এরপর ক্লোজ রেঞ্জ থেকে গুলি ছোঁড়ে। প্রথম গুলিটি দোকানের শাটারে লাগে, দ্বিতীয় গুলিটি সরাসরি আনাসের বুকে। গুলিবিদ্ধ হয়ে আনাস বুকে হাত দিয়ে কয়েক কদম এগিয়ে রাস্তায় লুটিয়ে পড়ে। সহযোদ্ধারা পরে তাকে উদ্ধার করে মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে যায়, কিন্তু ততক্ষণে সে শহীদ হয়ে গেছে। দুপুর ১টা ১৮ মিনিটে আনাসের মাকে ফোন করে বলা হয়, “আপনাদের কেউ আন্দোলনে গিয়েছিল? ইমার্জেন্সি মিটফোর্ডে আসেন।” হাসপাতালে পৌঁছে বাবা-মা দেখেন— দেশের পতাকায় মোড়ানো নিথর দেহ, বুক থেকে এখনও রক্ত ঝরছে। কোনো অ্যাম্বুলেন্স না পেয়ে অটোরিকশায় করেই তারা ছেলের লাশ ঘরে নিয়ে আসেন। সেদিন একই এলাকার আরেক শহীদ শেখ মেহেদির সঙ্গে তার জানাজা অনুষ্ঠিত হয় এবং তাকে দাফন করা হয় জুরাইন কবরস্থানে, প্রিয় দাদির কবরে।
পরিবারের শোক ও জাতির দায়
আনাসের মা সানজিদা খান দিপ্তী বলেন,
“ছেলের লাশ নিয়ে যখন ঘরে ফিরেছি, তখন তার শরীরে রক্ত আর অবশিষ্ট ছিল না।
সারা শহরের রাস্তায় ছড়িয়ে ছিল আমার ছেলের রক্ত।”
তার বাবা সাহরিয়া খান পলাশ বলেন,
“আমার ছেলে খুব ভদ্র ছিল, স্বপ্ন ছিল ইঞ্জিনিয়ার হবে।
ছেলেটার সেই স্বপ্ন আর পূরণ হলো না। পুলিশের গুলিতে ওর জীবন শেষ হয়ে গেল।
আমার ছেলে যেন রাষ্ট্রীয়ভাবে শহীদের মর্যাদা পায় — এইটাই আমার চাওয়া।”
মাত্র ১৬ বছরের কিশোর আনাস নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন দেশের ন্যায়বিচার ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মুক্তির জন্য। তার সাহস, তার চিঠি, আর তার রক্ত আজ কোটি তরুণের হৃদয়ে স্বাধীনতার নতুন শপথ জাগিয়েছে।
যতদিন তার হত্যাকারীদের বিচার না হবে, ততদিন জাতি শহীদ আনাসের রক্তের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে।





